“আওয়ামী লীগের ক্ষমা প্রার্থনা, তারপর?”

আলি শরিয়তির কলাম…

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কোটা আন্দোলন ডিল করতে আওয়ামী লীগ সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার ফলেই কোটা আন্দোলনকারীরা সফলতা অর্জন করেছে। ফলাফল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা ছিল বলেই আন্দোলনকারীরা সফল হয়েছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা ছিল বলেই আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি সফল হয়েছে।

বিগত সময়গুলোতে শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, অবশেষে সেই জঙ্গিবাদের মদদদাতা ও রক্ষকেরা শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে দেশ শাসনের ভার নিয়েছে।

গত প্রায় ১৫বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছিল, সেই লড়াইয়ে অবশেষে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ হেরেছে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিজয়ী হয়েছে। ফলাফল হলো সাম্রাজ্যবাদীদের আপন মানুষের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আরোহণ করেছে।

১/১১ এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশকে বিরাজনীতিকরণের যে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র চলে আসছিল, শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে তা ঘুমন্ত থাকলেও নিঃশ্বেস হয়নি। অবশেষে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ সেদিকে যাত্রারম্ভ করেছে।

একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ড, বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের অবৈধ দখলী বাড়ি উচ্ছেদ, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার, মোটাদাগে এগুলো করার মাধ্যমে রাজনৈতিক অপশক্তিকে শত্রু বানিয়েছেন শেখ হাসিনা। তাছাড়া জঙ্গি-রক্ষণশীল-ধর্মজীবী-ধর্মবাদী-ধর্মাশ্রয়ীদের রাজনীতি ও ভণ্ডামিকে কোণঠাসা করার দায়ও শেখ হাসিনার কাঁধে বর্তেছে। অথচ এসবের জন্য প্রগতিশীলদের কাছে সাপোর্টের বদলে ফ্যাসিস্টের তকমা পেলেন শেখ হাসিনা। সহযোগিতার বদলে স্বৈরাচারের খেতাব পেলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এগুলো কোন সংজ্ঞায়িত রাজনীতির ব্যাখ্যা নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পদলেহনকারীদের মিথ্যা অপপ্রচার। যার সত্যিকার উত্তর ভবিষ্যতে পাবে বাংলাদেশ।

৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগের কোন অনুশোচনা নেই, ভুলের জন্য মাফ চাওয়া নেই, অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাওয়ার বালাই নেই ইত্যাদি। এটা দুই পক্ষের মানুষই বলছে। দলের ভেতরের এবং বিপক্ষের, উভয়পক্ষেই একথা বলাবলি হচ্ছে। টিভি, পত্রিকা, ফেইসবুকের কল্যাণে এটা বেশ মার্কেট পেয়েছে। বলাবাহুল্য, বিরোধিপক্ষ অর্থাৎ ডানপন্থী ও বামাতি(হৃদয়ে জামায়াতি কিন্তু ওপরে প্রগতি) অংশটি চায় আওয়ামী লীগ নাকে খত দিক, আর তারা পৈচাশিক আনন্দ উপভোগ করুক।

তবে আমিও মনে করি, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন সম্বন্ধে দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগের ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনায় ছিল, ফলে দায়ভার তাঁদের ওপরেই বর্তায়। এজন্য দলের পক্ষ থেকে অবস্থান স্পষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা আছে। তাছাড়া পঁচাত্তরের পরেও আওয়ামী লীগ দলীয় অবস্থান পরিস্কার করেছিল। এখনও তাই করা উচিত। কারণ এই আন্দোলনে আওয়ামী লীগের দায় আছে, যেহেতু সরকারে ছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আওয়ামী লীগ সরকার হত্যা করতে বলেনি, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলেছে। আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় প্রশাসনিকভাবে মোকাবেলার চেষ্টা করেছে। সেখানে পুলিশ-বিজিবি-র্যা ব-সেনাবীহিনীর কোন কোন সদস্য অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে এবং সেটা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছিল সরকারের। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে। এই ব্যর্থতার দায় আওয়ামী লীগের নিতে হবে। এজন্য অবশ্যই দুঃখ প্রকাশ করা উচিত। আরেকটা বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ সরকার জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালে জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থ হয়েছে। এজন্যও দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু এই দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চাওয়ার অর্থ এই নয় যে, জুলাই-আগস্ট হত্যার পুরো দায় আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যাবে। এজন্য জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনের জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দলীয় কিছু রীতি-নীতির বিষয় আছে। এধরণের জাতীয় সংকট সম্বন্ধে দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য পরবর্তী জাতীয় সম্মেলনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় অথবা বিশেষ কাউন্সিল ডেকে উদ্ভুত পরিস্থিতির ব্যাখ্যা ও কাউন্সিলে পাশ করানোর রেওয়াজের বিষয় আছে। যা বর্তমান সরকারের চরম বৈরি আচরণের ফলে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। তাহলে উপায় একটাই আছে, পরবর্তী কাউন্সিলে অনুমোদনসাপেক্ষে অগ্রিম অবস্থান ব্যাখ্যা করা।

আচ্ছা, যারা ক্ষমা বা অনুশোচনার কথা বলছেন, তারা ঠিক কোন অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে বলছেন? আওয়ামী লীগ তো যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য ক্ষমা চাইবে না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার কার্যকর করার জন্য ক্ষমা চাইবে না। জাতীয় চারনেতা হত্যার বিচার করার জন্য ক্ষমা চাইবে না। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার জন্য ক্ষমা চাইবে না। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই ক্ষমা চাইবে না। তাহলে ঠিক কিসের জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন আসছে?

এসবের উত্তর কারও কাছে আছে ?

গত প্রায় তিন মাসে আওয়ামী লীগবিহীন বাংলাদেশে, আওয়ামী লীগের শত্রুরা কি কি করেছে সেটার বর্ণনা দিলেই বোঝা যাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমা চাওয়ার জিকির তোলা কেন পলিটিক্যাল মকারি।

এসব মকারি করে মার্কেট পাওয়া যাবে?

মতামতঃ সাব্বির খান।

সম্পর্কিত নিউজ

আরও পড়ুন