আওয়ামীলীগ সরকারের শেষ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভের পতন নিয়ে নানা সমালোচনা তৈরি হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আগের সপ্তাহেও রিজার্ভ তার পূর্ববর্তী তিন সপ্তাহের তুলনায় সাড়ে চার কোটি ডলার বাড়ার তথ্য জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের মোট গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে। জুলাই মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৬ বিলিয়ন ডলার, যা সরকার পতনের পর সামান্য কমে এসেছে। তবে বর্তমানে রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভের অবস্থা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশিত বিপিএম-৬ মানদণ্ড অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। বর্তমানে বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। জুলাইয়ের শেষে অর্থাৎ ৩০ জুলাই, সরকার পরিবর্তনের চার দিন আগে এই মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা নতুন সরকার আসার পর ২১ আগস্ট পর্যন্ত ২০ বিলিয়ন ডলার স্থিত ছিল।
অক্টোবরে রিজার্ভে সামান্য ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। ১২ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (আকু) বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা পরে তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ১৯ দশমিক ৭৬ বিলিয়নে উন্নীত হয়।
আকুর বিল পরিশোধ ও রিজার্ভের প্রভাব
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আকুর আমদানি বিল বাবদ প্রায় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে দেশের মোট গ্রস রিজার্ভ কমে সাড়ে ২৩ বিলিয়ন ডলারে নামবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ৩ নভেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট রিজার্ভ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার।
বিপিএম-৬ অনুযায়ী বর্তমান রিজার্ভ থেকে প্রায় ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। এ পরিমাণ আইএমএফের নির্ধারিত সীমা ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়নের কিছুটা নিচে রয়েছে।
রিজার্ভ বৃদ্ধিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, তিনি ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রিজার্ভের পতন রোধকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থপাচার রোধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তঃব্যাংক ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করেছে। কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধও রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ না করেই সম্পন্ন করা হয়েছে।
রিজার্ভ বৃদ্ধিতে প্রবাসী আয়ের অবদান
রিজার্ভ বৃদ্ধিতে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। গত অক্টোবর মাসে মোট ২৪০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে যা সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
আগের পরিস্থিতি ও বর্তমান স্থিতিশীলতা
২০২১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা কোভিড-১৯ মহামারি শেষে বিভিন্ন কারণে কমতে শুরু করে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি আমদানির আড়ালে অর্থপাচারও বৃদ্ধি পাওয়ায় রিজার্ভে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই সময়ে আমদানি খাতে সহায়তা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে, ফলে দুই অর্থবছরে রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যার ফলে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সামান্য ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।